বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত শহর কক্সবাজার কিসের জন্য বিখ্যাত প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় কক্সবাজার তার নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের জন্য বিখ্যাত। বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার যা ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। কক্সবাজারে আছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ সামুদ্রিক মৎস্য বন্দর এবং সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন।
কক্সবাজার কিসের জন্য বিখ্যাত প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে সবার আগে জানতে হবে কক্সবাজার এর ইতিহাস ও পরিচিতি। কক্সবাজার জেলা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পর্যটন জেলা হিসেবে পরিচিত। ছুটির দিনে লাখ লাখ ভ্রমণ পিপাসু মানুষ ঘুরতে আসে এই কক্সবাজার জেলায়।
কক্সবাজার নামটি আসছে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স এর নাম অনুসারে। হিরাম কক্স ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসার ছিলেন। কক্সবাজার এর রামু উপজেলায় কক্স সাহেবের বাংলো নামে একটা বাড়ি আছে যেখানে ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স থাকতেন বলে ধারণা করা হয়। আবার ইতিহাস অনুযায়ী কক্সবাজারের পূর্বের নাম পালংকি।
অনেকের মতে কক্সবাজার পানোয়া নামে-ও পরিচিত ছিল যার অর্থ হলুদ ফুল। কক্সবাজার নামের ইতিহাস যখন জানলেন, চলুন এবার জেনে নিই কক্সবাজার কিসের জন্য বিখ্যাত। কক্সবাজার কে চিনতে হলে এর বিখ্যাত হওয়ার গল্প তো অবশ্যই জানতে হবে।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের একটি সৈকত যা পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত। তবে ব্রাজিলের কাসিনো সমুদ্র সৈকত বিশ্বের প্রথম যার দৈর্ঘ্য ২১২ কিলোমিটার এবং অস্ট্রেলিয়ার ১৫১ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত বর্তমানে পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম সৈকত, তবে তথ্য অনুযায়ী অস্ট্রেলিয়ার সৈকতের কিছু অংশ মানুষের দ্বারা সৃষ্টি করা। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা যেখানে বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ-ও ঘুরতে আসে।
চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৫২ কিলোমিটার দক্ষিণে কক্সবাজার জেলা অবস্থিত। ঢাকা থেকে যার দূরত্ব ৪১৪ কিলোমিটার। এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পর্যটন কেন্দ্র। রাজধানী ঢাকা থেকে সরাসরি সড়কযোগে এবং আকাশপথে কক্সবাজার যাওয়া যায়। বর্তমানে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করায় ঢাকা থেকে কক্সবাজার এক্সপ্রেস ও পর্যটন এক্সপ্রেস নামের ২টি ট্রেন নিয়মিত চলাচল করছে।

উক্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প সমাপ্ত হওয়ার পর ১১ নভেম্বর, ২০২৩ ইং বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারে নবনির্মিত আইকনিক স্টেশনে উক্ত রেলপথ উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনের পর ১ ডিসেম্বর, ২০২৩ ইং বাণিজ্যিকভাবে ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে যা এখনো সচল রয়েছে। চট্টগ্রাম থেকেও একইসাথে ট্রেনযোগে কক্সবাজার যাওয়া যাচ্ছে।
জেনে নিন কক্সবাজার কিসের জন্য বিখ্যাত?
প্রশ্নটা যখন কক্সবাজার কিসের জন্য বিখ্যাত তখন এর সহজ উত্তর হচ্ছে কক্সবাজার তার সমুদ্র সৈকত এর জন্য সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত। সমুদ্র সৈকত বেশ কিছু অংশের সমষ্টি যা প্রধানত লাবণী পয়েন্ট, কলাতলী পয়েন্ট, সুগন্ধা পয়েন্ট, দরিয়ানগর সৈকত, হিমছড়ি, ইনানী সৈকত এবং টেকনাফ নিয়ে সমৃদ্ধ।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত বললেই চোখে ভেসে ওঠে লাবণী পয়েন্ট। সমুদ্র দেখতে বাঙালিরা সবার আগে ছুটে যান কক্সবাজারের লাবণী পয়েন্টে। কলাতলী পয়েন্ট থেকে রিকশাযোগে অথবা পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় এই পয়েন্টে। কক্সবাজার শহর থেকে কাছে হওয়ায় লাবণী পয়েন্টকে কক্সবাজারের প্রধান সমুদ্র সৈকত বলে বিবেচনা করা হয়।
রকমারি জিনিসের সংগ্রহ নিয়ে সৈকত সংলগ্ন এলাকায় আছে ছোট বড় অসংখ্য দোকান যা সকল ধরণের পর্যটকের আকর্ষণ করে। এখানে পর্যটকদের জন্য আর-ও গড়ে উঠেছে ঝিনুক মার্কেট। মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন প্রভৃতি দেশ থেকে আমদানি করা নানারকম জিনিসপত্র নিয়ে সাজানো হয়েছে মার্কেটগুলো।
কলাতলী পয়েন্ট কক্সবাজারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় সৈকত। এটা কক্সবাজারের একদম মোড়ে অবস্থিত। শহরে ঢুকতেই একদম কলাতলী পয়েন্ট, যার কারণে অনেকের কাছে এই পয়েন্টের আলাদা গ্রহণযোগ্যতা থাকে। দূরদূরান্ত থেকে বাস যোগে আসলে গাড়ি থেকে নেমেই কলাতলী সৈকতে যাওয়া যায়। স্থানীয় মানুষেরা-ও নিয়মিত এখানে ঘুরতে আসেন।
অনেকে সমুদ্রে গোসল করতে এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে আসেন। কলাতলী পয়েন্টে বিভিন্ন রকমের রেস্টুরেন্টসহ আছে রাস্তার পাশের ছোট ছোট ফুডকার্টের দোকান। আবার এই কলাতলী পয়েন্টে পূর্ণিমার রাতে সৈকতে হাঁটা সকল বয়সী মানুষের জন্যই রোমাঞ্চকর। কক্সবাজারে আসা সকল যানবাহন কলাতলী পয়েন্ট দিয়েই শহরে প্রবেশ করে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই পথেই ফিরে যায়।
কলাতলী থেকে একটু দূরে উত্তর দিকে আরেকটি চমৎকার জায়গা আছে যার নাম সুগন্ধা পয়েন্ট। এই সুগন্ধা পয়েন্টেই অবস্থিত কক্সবাজারের জনপ্রিয় বার্মিজ মার্কেট। এই পয়েন্টে অধিকাংশ মানুষ সৈকতে আসতে পছন্দ করে। বিশেষ করে স্থানীয় মানুষ যারা একটু কম কোলাহল পছন্দ করে তারা এই পয়েন্টে আসে।
স্থানীয় মানুষ সহ প্রায় সকলের কাছেই দরিয়ানগর সৈকত বেশ জনপ্রিয়। হিমছড়ি জাতীয় পার্কের কাছেই এই দরিয়ানগর সৈকত অবস্থিত। দরিয়ানগর সৈকতের মধ্য দিয়ে জলপথ প্রবাহিত হয়। অধিকন্তু, প্যারাসেলিংয়ের জন্য দরিয়ানগর সৈকত বেশ জনপ্রিয়।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে দক্ষিণে ১২ কিলোমিটার পর হিমছড়ির অবস্থান। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠা পর্যটন কেন্দ্র ও সমুদ্র সৈকতের নাম হিমছড়ি। হিমছড়ির সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের চেয়ে নির্জন ও তুলনামূলক পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন। এর সৌন্দর্যও অপরূপ। তবে হিমছড়ি যতটা না সুন্দর তার চেয়ে সুন্দর এবং রোমাঞ্চকর হলো কক্সবাজার শহর থেকে হিমছড়ি যাওয়ার পথ। এ পথের একপাশে বিস্তৃর্ণ সমুদ্রের বালুকাবেলা আর একপাশে সবুজ পাহাড়ের সারি।
এরই মাঝে পিচ ঢালা মেরিন ড্র্রাইভ। এমন দৃশ্য দেশের আর কোথাও পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। হিমছড়ি পাহাড়ে উঠলে চোখের সামনে ভেসে বেড়াবে নীল দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া এক বিশাল সমুদ্র।
আরেকটি পরিচিত সৈকত ইনানী যা ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং এটি কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলায় অবস্থিত। এটি কক্সবাজার শহর থেকে ২৮ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। ইনানী সৈকতে রয়েছে সবুজ ও কালো রঙের অসংখ্য প্রবাল পাথর যা এই সৈকতের সৌন্দর্য অধিকাংশে বাড়িয়ে তোলে।
আর-ও একটি সৈকত আছে যা কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলায় অবস্থিত। টেকনাফের এই অংশটা কক্সবাজারের অন্যান্য অংশ থেকে আলাদা। গাছ-গাছালিতে পরিপূর্ণ টেকনাফ ম্যানগ্রোভের তীরে অবস্থিত এই টেকনাফ সৈকত। টেকনাফের এই সৈকত আবার বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত যার প্রধান শ্যামলাপুর সৈকত, শিলাখালী সৈকত ও হাজামপাড়া সৈকত।
কক্সবাজারে বিভিন্ন উপজাতি বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ বাস করে যা কক্সবাজার শহরকে করেছে আরো বৈচিত্র্যময়। এসব উপজাতিদের মধ্যে চাকমা সম্প্রদায় প্রধান। কক্সবাজার শহর এবং এর অদূরে অবস্থিত রামু উপজেলায় রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত অসংখ্য বৌদ্ধ মন্দির।
কক্সবাজার শহরে যে মন্দির রয়েছে তাতে আছে বেশ কিছু দুর্লভ বুদ্ধ মূর্তি। এই মন্দির এবং মূর্তিগুলো পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
রামু উপজেলায় ঐতিহাসিক রামকোট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহার, ১০০ ফুট সিংহশয্যা গৌতম বুদ্ধ মূর্তি, রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার, সাদা চিং, লাল চিং, অপর্ণাচরণ বৌদ্ধ বিহার, উছাই ছেন রাখাইন বৌদ্ধ বিহার (বড় ক্যাং), শ্রীকুল পুরাতন বৌদ্ধ বিহার, লামারপাড়া বৌদ্ধ বিহার সহ আছে অসংখ্য নতুন ও পুরাতন বৌদ্ধ বিহার। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রামু ও উখিয়ায় সাম্প্রদায়িক হামলা ও বৌদ্ধ বিহার অগ্নিসংযোগ এ রামুর প্রাচীন এই বৌদ্ধ বিহারগুলো পুড়ে যায়।
এর কারণে হারিয়ে যায় প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের অবয়ব এবং অসংখ্য দামি বুদ্ধ মূর্তি সহ তালপাতায় লেখা ত্রিপিটক ও মূল্যবান ধর্মীয় গ্রন্থ। পরবর্তীতে সরকারিভাবে এসব বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করে দিলেও দালানের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় না সেই পুরনো বৌদ্ধ বিহার।
কক্সবাজারে আর-ও আছে বাঁকখালী নদী। এই বাঁকখালী নদী কক্সবাজারের মৎস্য শিল্পের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন, মহেশখালী, ছেঁড়াদ্বীপ, রামুর রাবার বাগান, লাওয়ে জাদি সহ আর-ও অসংখ্য দর্শনীয় স্থান আছে কক্সবাজারে। অধিকন্তু, কক্সবাজার কিসের জন্য বিখ্যাত জিজ্ঞেস করলে বলা যায়, কক্সবাজার বাংলাদেশের সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে বিখ্যাত।
এসকল কারণে আসলেই কক্সবাজার বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত শহর এবং গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন এলাকা। কক্সবাজার কিসের জন্য বিখ্যাত প্রশ্নের উত্তরে অবিরত বলা যাবে এর বিখ্যাত হয়ে উঠার গল্প। আজ এ পর্যন্ত-ই। আবার-ও কথা হবে পরবর্তী কোনো শহরের বিখ্যাত হওয়ার গল্প নিয়ে।