বর্তমানে পর্যটকদের আগ্রহ রামু উপজেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ নিয়ে। কারণ ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি প্রকৃতি পরিবেশ মিলে রামু এক অন্যান্য সৌন্দর্য।
বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা হচ্ছে এই ‘রামু’। বহুবছরের ইতিহাস ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন, পরিবেশ প্রকৃতি নিয়ে এই রামু এক সৌন্দর্যের মহা রাণী হিসেবে পরিচিত। এমনকি যার নামে কক্সবাজারের নামকরণ সেই ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স এর বাংলো ও এই রামুতে।
তাই শুধু দেশীয় পর্যটকদের কাছে নয় বরং বিদেশি পর্যটকদের কাছে ও এই রামু আকর্ষণীয় একটা জায়গা। চলুন এইবার জেনে নিন রামু উপজেলার দর্শনীয় স্থান গুলো যেখানে আপনি ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রকৃতি ও নানান রকমের সৃষ্টি দেখতে পারবেন। তাছাড়া উপলব্ধি করতে পারবেন সম্প্রতির মেল বন্ধন।
জেনে নিন রামু উপজেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ:

রামুর বৌদ্ধ বিহার: রামু উপজেলার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং ঐতিহাসিক স্থান গুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রামুর বৌদ্ধ বিহার গুলো। এইখানে প্রায় ১০/১২ টি মতো বৌদ্ধ বিহার রয়েছে। একেকটি বৌদ্ধ বিহার শত শত বছরের ও পুরোনো।
তাও আবার বিভিন্ন কারুকাজ করা, কাঠের বৌদ্ধ বিহার। ( তবে ২০১২ সালে সাম্প্রতিক হামলায় বেশ কিছু বিহার পুরিয়ে দেয়া হয়। যদিও সরকার থেকে নতুন বিহার দেয়া হয়েছিল কিন্তু আগের ঐতিহাসিক সেই কাঠের কারুকাজকৃত বিহার গুলো নেয়)
কাঠের বৌদ্ধ বিহারের মধ্যে রয়েছে চ্যারাংঘাটা রাখাইন বৌদ্ধ বিহার, লামার পাড়া বৌদ্ধ বিহার , শ্রীকুল পুরাতন বৌদ্ধ বিহার।
উসাই-ছেন (রাখাইন) রামু বড় ক্যাং: রামু চৌমুহনী স্টেশন থেকে চেরাংঘাটা রোডে ৫ মিনিট গেলে এই বিহার অবস্থিত। অনেক বছরের পুরোনো এই বিহার। ভেতরে ঢুকলে আলদা একটা শান্তি অনুভব হবে। এটি বড় ক্যাং নামে পরিচিত স্থানীয় জনগণের কাছে। ক্যাং অর্থ বিহার।

বাঁকখালী নদী: চেরাং ঘাটা বিহার থেকে বের হয়েই হাতের ডানে ২ মিনিট গেলে এই নদী। নদীর ওপারে গ্রাম। দূরে বাম পাশে যদি খেয়াল করেন তাহলে দেখতে পারবেন একটা জাদি। যা অনেকটা বান্দরবানের স্বর্ণ মন্দিরের মতো। তবে এটি লাওয়ে যাদি। যা মাটি থেকে অনেক ফুট উঁচুতে অবস্থিত।
ভারতের মিজোরাম রাজ্যের দক্ষিণ – পাহাড় থেকে সৃষ্ট স্রোতধারা বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়িতে মিলিত হয়ে বাকঁখালী নদী সৃষ্টি হয়েছে।
বাঁকখালী নদী শুধু একটা নদী নয়, এটি অনেক পুরনো ইতিহাসের সাক্ষী। এই নদীপথ ধরে এক সময় এসেছে আরবের ব্যবসায়ীরা, পর্তুগিজরা এবং আরাকানের জলদস্যুরা। পরে ব্রিটিশ ব্যবসায়ীরাও এসেছে এই পথ ধরে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ব্রিটিশ এবং মার্কিন সেনারা কক্সবাজারে অবস্থান করেছিল। তখন বাঁকখালী নদীর ওপর কাঠের একটি জেটি তৈরি করা হয়। যুদ্ধের জন্য যেসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনা হতো, সেগুলো এই জেটিতে ভিড়ানো জাহাজ থেকে নামানো হতো।
জানা যায় ক্যাপ্টেন হিরাম কক্সের সমাধি ও এই বাকঁখালী নদীর পাড়েই করা হয়েছিল কিন্তু নদী ভাঙ্গনের ফলে তা তলিয়ে যায়।
শ্রীকুল পুরাতন বৌদ্ধ বিহার: রামুর আর একটি পুরাতন কাঠের বৌদ্ধ বিহার এটি। প্রায় ১৫০ বছরের প্রাচীন এই বৌদ্ধ বিহার। যেখানে আছেন বৌদ্ধদের পরম পূজনীয় ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় ভদন্ত উ চেকাচারা মহাথের। যিনি বর্তমানে শত তম বছরের জীবন অতিবাহিত করছেন ধর্ম প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে।
মৈত্রী বিহার/ সাদা চিং / লাল চিং: এই বিহার ৩টি একদাম পাশাপাশি অবস্থিত। শ্রীকুল বিহারটির একদম পাশেই এই গুলো। লাল চিং বিহার টি আগে কাঠের ছিলো যা ২০১২ সালে পুরিয়ে দেয়া হয়। বর্তমানে যা আছে তা সরকারি ভাবে করা ২০১২ এর পর।
রাংকূট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহার: রামু চৌমুহনী স্টেশন থেকে ক্যান্টরমেন্ট এর দিকে যাওয়ার আগে এই বিহারটি অবস্থিত। এটি কক্সবাজার জেলার প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ বিহার। ঐতিহাসিক ভাবে এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয়। মৌর্য বংশের তৃতীয় রাজা সম্রাট অশোক এটি স্থাপন করেন।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫৮০ থেকে ৫২৮ সালের মাঝে প্রাচীন আরাকানের ধন্যবতী (যা এখন ধাঁইয়াওয়াদি নামে পরিচিত) শহরের রাজা মহাচন্দ্র সুরিয়ার আমন্ত্রণে গৌতম বুদ্ধ তাঁর শিষ্যদের নিয়ে এই অঞ্চলে আসেন। তখন তিনি বর্তমান চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে ধন্যবতী নগরে যাওয়ার পথে এক স্থানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেন।
সেখানে তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য আনন্দ স্থবিরকে বলেছিলেন, “হে আনন্দ! একদিন পশ্চিমের সমুদ্রের পূর্ব তীরের রম্যবতি নগরের এক পাহাড়চূড়ায় আমার বক্ষাস্থি স্থাপন করা হবে। তখন এই জায়গার নাম হবে ‘রাং-উ’। ‘রাং’ মানে বক্ষ, ‘উ’ মানে বক্ষস্থিত কিছু। আর ‘কূট’ শব্দের মানে হলো স্থান।” এই ভবিষ্যদ্বাণী থেকেই ‘রামকূট’ নামের উৎপত্তি বলে বিশ্বাস করা হয়।
পরে সম্রাট অশোক বুদ্ধের জীবনের ৪৫ বছরের বাণী ও শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে ৮৪ হাজার চৈত্য নির্মাণ করেন। ধারণা করা হয়, রামকূট বৌদ্ধ বিহার ছিল সেই ৮৪ হাজারের একটি।
খ্রিষ্টপূর্ব ৩০৮ সালে আরাকানের রাজা চন্দ্রজ্যোতি (চেঁদি রাজা নামে পরিচিত) বুদ্ধের বক্ষাস্থি একটি সাদা পাথরের তৈরি ৬ ফুট উঁচু বুদ্ধমূর্তির মাথায় স্থাপন করে এখানে প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সময়ের সাথে সাথে এই স্থাপনার অস্তিত্ব হারিয়ে যায়।

চীনের পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙের লেখা ভ্রমণবর্ণনাতেও এই বিহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ১৬৬৬ সালে মুঘলদের আক্রমণে বিহারটি ধ্বংস হয়ে যায়।
১৯৩০ সালে ব্রহ্মদেশের এক ভিক্ষু ও শ্রীলঙ্কান পুরোহিত জগৎচন্দ্র মহাস্থবির শ্রীলঙ্কায় থাকাকালীন এক প্রাচীন শিলালিপি খুঁজে পান। সেই শিলালিপির তথ্য অনুযায়ী অনুসন্ধান ও খননের মাধ্যমে ১৯২৯ সালে তিনি রামকূট বৌদ্ধ বিহারটি আবার খুঁজে পান ও পুনর্নির্মাণ করেন।
এরপর থেকে এখানে নিয়মিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান, মেলা ও পূজা উদযাপিত হয়ে আসছে।
জানা যায়, ১৯৬৬ সালের দিকে মন্দির সংস্কারের কাজ শুরু হলে প্রজ্ঞাজ্যোতি মহারেথ নামের একজন ভিক্ষু টানা ২০ বছর এখানে থাকেন। তবে ১৯৮৮ সালে এক ডাকাতির ঘটনার পর তিনি রাংকূট ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন।
জেলা পরিষদ বাংলো / কক্স সাহেবের বাংলো: কক্সবাজার নামটি যার নামে দেয়া সেই ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স এর বাংলো ও রামুতে অবস্থিত। রামু উপজেলার দর্শনীয় স্থান হিসেবে এটি ও অন্যতম। রাংকূট বিহার দেখে আসার পথে এটি অবস্থিত। যা একদম মেইন রোডের সাথে।
লামার পাড়া বৌদ্ধ বিহার: কাঠের প্রাচীন ও ঐতিহাসিক বিহারের মধ্যে এটি ও একটি। এইখানের কারু কাজ গুলো খুবই মনোমুগ্ধকর। এইখানে রয়েছে পিতলের ঘন্টা যার ও ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্ব রয়েছে।
রাংকূট বিহার দেখে আসার পথে এটি দেখতে পারেন। এটি অফিসের চর এলাকায় রাংকূট থেকে আসার সময় হাতের বামে দিয়ে যেতে হবে। তবে এটি সব সময় খোলা থাকে না। বিকেল ৪ টার আগে যেতে হবে যদি যেতে চান।

রামু সীমা বিহার: রামু উপজেলার মূল স্টেশনের মধ্যে এই বিহারটি অবস্থিত। স্টেশন থেকে একটু দূরে হাতের বাম পাশে এই বিহার অবস্থিত। বাংলাদেশ সরকার কতৃক একুশে পদক প্রাপ্ত ও সর্বজন পূজনীয় ও বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরুর মধ্যে ছিলেন সত্যাপ্রিয় মহাথের। যিনি এই বিহারের অধ্যক্ষ হিসেবে ছিলেন। যদিও বা উনি প্রয়াত হয়েছেন অথার্ৎ মারা গেছেন।
১০০ ফুট বুদ্ধ মূর্তি: কক্সবাজারের বৌদ্ধ বিহার গুলোর মধ্যে অন্যতম আকর্ষণ এই ভুবন শান্তি ১০০ ফুট সিংহ শয্যা গৌতম বুদ্ধ মূর্তি। এটি রামু স্টেশন থেকে কক্সবাজার – চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয় উত্তর মিঠাছড়ির দিকে হাতের বাম পাশে অবস্থিত।
রামু রাবার বাগান: রামুর পর্যটন জায়গা হিসেবে এই রাবার বাগান ও অন্যতম। এইখানে রয়েছে রেস্ট হাউস ও। রেস্ট হাউসের চারদিকে আরকান সড়কের উভয় পাশে অর্থাৎ কক্সবাজার – চট্টগ্রাম সড়কের পাশে বিশাল এই রাবার বাগান অবস্থিত। ১০০ ফুট বুদ্ধ মূর্তি দেখে আপনারা চাইলে এই রাবার বাগান ও দেখতে পারেন। মেইন রোডে এসে হাতের বামে ৫ মিনিটের দূরত্বে এই রাবার বাগান ও রেস্ট হাউস।
কিভাবে যাবেন রামু উপজেলার দর্শনীয় স্থান গুলোতে:
আপনি যদি কক্সবাজার থেকে আসেন তাহলে সিএনজি বা কক্স লাইন ( মিনি বাস) এর মাধ্যমে আসতে পারেন। প্রথমে উসাই সেন রাখাইন বড় ক্যাং এরপর বাকঁখালী নদী, শ্রীকুল পুরাতন বৌদ্ধ বিহার দেখে পাশের মৈত্রী বিহার, লাল চিং, সাদা চিং।
এরপর চৌমুহনী স্টেশনে এসে রাংকূট বিহার, রাংকূট দেখে এর পাশে একটা শিশু সদন আছে সুযোগ থাকলে সেটা দেখতে পারেন,এরপর সেখান থেকে ফেরার পথে কক্স সাহেবের বাংলো, তারপর লামার পাড়া বৌদ্ধ বিহার ( এটিতে কিন্তু বিকেল ৪ টার মধ্যে যেতে হবে) ।
এর পর রামু সীমা বিহার দেখে ১০০ ফুট বুদ্ধ মূর্তি এবং রাবার বাগান দেখে সোজা কক্সবাজার চলে যেতে পারবেন।
রামু কক্সবাজারের সেরা ১০ টি দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে অন্যতম। আপনি যদি কক্সবাজার আসেন তাহলে অবশ্যই ঐতিহাসিক, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জায়গা রামু কে দেখতে ভুলবেন না।
কক্সবাজারে আরো নানান রকমের দর্শনীয় স্থান রয়েছে বিশেষ করে পাহাড়ের মনোরম পরিবেশ ও উপভোগ করতে পারবেন আপনি কক্সবাজারে এসে।
পর্যটন প্রেমেদের মূল আকর্ষণ থাকে সমুদ্র ও পাহাড়। যা আপনি একসাথে পাবেন। কারণ রামু থেকে ঠিক পাশেই বান্দরবান উপজেলার কিছু জায়গা আছে যেখানে আপনি পাহাড়ের স্বাদ টা পেয়ে যাবেন।
কক্সবাজারে সেরা TOUR Package পেতে ও সকল ধরনের পরামর্শ ও সেবা পেতে যোগাযোগ করতে পারেন প্রতিবেশী’র সাথে। যারা বিশ্বাস ও সততার সাথে কাজ করে থাকে।
যোগাযোগ: pratibeshi.com Call or What’sapp: 01787771200